ফিরে এসো জবালা
-রীণা চ্যাটার্জী
সাহসিনী,
অচেনা, বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া, ভুলে যাওয়া একটা নাম তুমি। পরিচয়! তুমি নারী, তুমি দেহপসারিনী, তূমি উচ্ছৃঙ্খল, তুমি বহুভোগ্যা, তুমি দাসী। তথাকথিত বর্ণপ্রথার ধারাবাহিকতায় বিশ্বাসী সমাজের ঘৃণিত, নীচু শ্রেণীর একজন তুমি– জবালা তোমার নাম। তোমার আর এক পরিচয়, তুমি মা- ‘সত্যকামের মা’। তোমার সন্তান উপাধিধারী, বংশ পরিচয়ের বৃথা অহঙ্কারের ‘ব্রাহ্মণ’ নয়, প্রকৃত ব্রহ্মজ্ঞানী, ইন্দ্রিয় জয়ী, তেজস্বী ‘সত্যকাম’।
আমার চোখে তুমি এক অদম্য সাহসিনী ‘মা’- যে তার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছে, লালন-পালন করেছে মাতৃস্নেহে। যৌবনের ধর্মে সন্তানসম্ভবা হলে তোমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। ঔরসধারীর পরিচয়, অনুমতির অপেক্ষা করো নি। অবশ্য স্বীকৃতি কেই বা দিত! যদিও সেই ব্যক্তি বড়ো হতভাগ্য.. সে বঞ্চিত হলো সন্তানের কৃতিত্বের গর্ব থেকে। ভবিষ্যত দ্রষ্টা হলে এ সুযোগ বোধহয় হারাতো না, পিতৃত্বের দাবী নিয়ে সজাগ থাকতো।
ভূমিষ্ঠ জাতকের নাম দিয়েছো তুমি ‘সত্যকাম’, কি পবিত্র নিগূঢ় অর্থ! ভাবলে শিহরিত হয়ে উঠতে হয়।
‘সত্যকাম’-কে হতে হয়নি অনাহুত ভ্রুণ, ঠাঁই পায়নি আস্তাকুঁড়ে কিংবা কোনো দুর্গম জায়গায়, পাশে বসে থাকেনি কোনো চিল, শকুন, শিয়াল লোভাতুর ক্ষুধার্ত দৃষ্টি নিয়ে সদ্যোজাতের লোভনীয় স্বাদ নেবার জন্য। পালিত হতে হয় নি অজ্ঞাত পরিচয়ের বোঝা নিয়ে সে তো শুধুই তোমার জন্য জবালা।
আজ এতো যুগ পরেও তোমার মতো সাহস দেখাতে পারেন খুব কম সাহসিনীরা, যাঁরা সরে যান না তাঁদের মাতৃ ধর্ম থেকে, লজ্জিত হন না তাঁদের মাতৃত্বে, পিতৃহীন পরিচয়ের ভয়ে বঞ্চিত করেন না সন্তানকে তার প্রাপ্য স্নেহটুকু দিতে- সমাজের কটাক্ষ, নিপীড়ন উপেক্ষা করে জন্ম দেন তাঁর সন্তানের, একটি প্রাণ ভূমিষ্ঠ হয়।
তবুও সমাজ যখন পিতৃপরিচয় চায় সেই সন্তানের, তখন অনেকেই নেন ছলনার আশ্রয়। বিভিন্ন কারণে, ভয়ে- সমাজের কাছে সত্য গোপন করেন। কারণ সমাজ এখনো মনে প্রাণে পিতৃতান্ত্রিক। তাই হয়তো বা লজ্জায় সন্তানের কাছে তুলে ধরতে পারেন না নির্দ্বিধায় অতীত কাহিনী। ভয় তো থেকেই যায় ভবিষ্যতে অতীতের অবগুণ্ঠন খুলে যাওয়ার। তাই দেখা যায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই সন্তান ভবিষ্যতে জন্মের প্রতি, জীবনের প্রতি এক দুরন্ত অভিমানে, অভিযোগে বিপথগামী হয়, বা স্নেহের পবিত্র সম্পর্কটুকু নির্দ্বিধায় ছিন্ন করে (ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে)। সত্যকে সহ্য করতে পারে না নির্ভীক চিত্তে।
‘সত্যকামে’র সত্যকে নির্ভীক চিত্তে মেনে নেওয়ার মন্ত্রে দীক্ষা তুমি কি তাকে তোমার গর্ভে থাকাকালীন দিয়েছিলে? কোন ভরসায় বলেছিলে, নির্ভীক চিত্তে অবলীলায় তার জন্মের ইতিহাস? শুধুই সত্যের জোরে! তাই কি তোমার সন্তানের দীপ্ত, দর্পিত পদক্ষেপ- মাতৃ পরিচয়ের সম্বল নিয়ে অহঙ্কারী, দাম্ভিক পিতৃতান্ত্রিক সমাজে! যাঁর সত্যবাদীতায় মুগ্ধ, স্তম্ভিত হয়ে যান ঋষি গৌতম, শিষ্যত্বে বরণ করে নেন সমাদরে। ভবিষ্যতের ইতিহাস পেল প্রকৃত জ্ঞানী, ব্রহ্মজ্ঞানী ইন্দ্রিয়জয়ী ‘সত্যকাম’।
তোমার সন্তানও ঠিক তোমার মতোই সমাজকে আর এক নতুন বার্তা দিল। জন্মে-বংশে নয়, কর্মে-মেধায় খুঁজে নিতে পরিচয়ের আসল কৌলিন্য। স্বীকৃতি দিলো মাতৃ পরিচয়ের, স্বাক্ষর দিলো সাহসের, মেধার, বিচক্ষণতার। রত্নগর্ভা ধন্য তুমি, কালজয়ী জ্ঞানী তোমার সন্তান। অবশ্যই সব-সবটুকু প্রাপ্তি ঘিরে তোমার সাহসী পদক্ষেপ। মাতৃগর্ভের, মাতৃক্রোড়ের সার্বজনীন স্বীকৃতির জন্য প্রয়োজন শত শত সত্যকাম।
বর্তমানে শিক্ষার মিথ্যা দম্ভে সমাজের অবক্ষয় ভীষণ পীড়াদায়ক। শৈশব, পরিচয়, অস্তিত্ব সব অদৃশ্য জাঁতাকলে পিষে চলেছে অবিরাম। সমাজের উন্নাসিকতার তুলাদণ্ড আজো বিচার করে মেধা। মেধা- শিক্ষা-চেতনা সবকিছু আজ দামী পসরা, উচ্চমূল্যে বিনিময় হয়। আমাদের আবারও ভীষণ প্রয়োজন জানো ইন্দ্রিয়জয়ী প্রকৃত জ্ঞানীর। ভেকধারীর মুখোশ খুলে দিতে দরকার অগুনতি ‘সত্যকাম’। নব উন্মেষের, উন্মুক্ত চিন্তার কান্ডারীর হাতে সমাজকে সঁপে দিয়ে যেতে শতরূপে ফিরে এসো জবালা, কোলে নিয়ে ‘সত্যকাম’।
প্রতীক্ষা
অসাধারণ লেখনী সম্ভারে পূর্ণ, সত্যিই সত্যকামের আবির্ভাব নিয়ে আসুক জবালা
স্বীকৃত হোক এই আবির্ভাব। ধন্যবাদ বন্ধু
অসাধারণ,মন ভরে গেল।
ধন্যবাদ বন্ধু
অসাধারন এক লেখা, কোনো প্রশংশাই যথেষ্ঠ নয়। সত্যিই আজ ‘জবালা’ র মতো মাতা আর ‘ সত্যকাম’ এর মতো পুত্রের বড়োই প্রয়োজন। এই নষ্ঠ হয়ে যাওয়া, ধীরে ধীরে অবক্ষয়ের চুড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যাওয়া মুমূর্ষু সমাজের বুকে নতুন প্রান সঞ্চয় এর জন্য বড়োই প্রয়োজন।
প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে..
অসাধারণ, অপূর্ব লেখনী ও ভাবনা 💕
ধন্যবাদ বন্ধু
অসাধারণ একটি রচনা
রচনা! ধন্যবাদ ভাই